সড়কে শৃঙ্খলা নিশ্চিতে জেলা প্রশাসনের মোবাইল কোর্ট
অনলাইন ডেস্ক নিউজ
সাফ ফুটবলের আকাশ ছুয়ে আসার নারী দলকে ঘিরে উচ্ছ্বসিত পুরো বাংলাদেশ। এ উচ্ছ্বাস স্রেফ একটি দলের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের নয়। সামাজিক প্রেক্ষাপটে এ জয় যেন এক মুক্তির গান, অবহেলা ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ।
মহিলা ফুটবল দল কাঠমাণ্ডু থেকে গত পরশু শিরোপা নিয়ে ফেরার পর মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত সাবিনারা আশা করছেন, নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের অধিকার অবশেষে মিলে গেছে তাদের; কিন্তু বিজয়ীদের বরণ অনুষ্ঠানকে ঘিরে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যা সাবিনাদের আশাবাদে সংশয়ের টুকরা মেঘ হয়ে জমেছে। বুধবার দুপুরে সাফ জিতে আসা মেয়েরা দেশে পা রাখার কিছুক্ষণ পর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উদযাপনের ছবিই বেশি দেখা গেছে; কিন্তু সময় গড়াতেই দুটি ছবিকে ঘিরে নিন্দার ঝড় উঠেছে।
তবে প্রথমটি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অন্যটি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে (বাফুফে) অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনের। প্রথম ছবিতে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী, তার মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং বাফুফের কিছু কর্মকর্তার গলায় মালা শোভা পাওয়া নিয়ে সমালোচনার স্রোতে ভেসে গেছে ফেসবুক।
তবে দ্বিতীয় ছবিতে দেখা গেছে, আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে বাফুফে সভাপতি, ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী, সচিব ও বাফুফের এক কর্মকর্তা মঞ্চে বসে। অথচ অধিনায়ক সাবিনা খাতুন পেছনে দাঁড়িয়ে, কোচকে খুঁজে পাওয়াই কঠিন! অথচ খেলার মাঠে যেকোনো সাফল্যের কারিগর খেলোয়াড়রা। আর ফুটবলে এই সাফল্যের সমান অংশীদার কোচ। ফুটবলে কোচরাই দলের নিয়ন্ত্রক, মন্ত্রণালয় দূরের কথা, খোদ ফুটবল সংস্থাও নয়।
এনিয়ে গোলাম রব্বানী ছোটনের মতো কোচদের ভাগ্য অতটা অনুকূল নয়। কাঠমাণ্ডুতে ব্যর্থ হলে নিশ্চিতভাবেই থাকে ঠেলে দেওয়া হতো সংবাদমাধ্যমের সামনে। প্রয়োজনে বরখাস্তও করা হতো কিন্তু দল জিতেছে। তাই গোলাম রব্বানী উদযাপনের ছবির ফ্রেমেই জায়গা পান না, সাবিনার জায়গা হয় মঞ্চের পেছনে।
এ নিয়ে জনমনে তীব্র সমালোচনা ঝড় উঠছে হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। তথ্য-প্রযুক্তির যুগে এখন বিশ্ব ফুটবলের খোঁজখবর সবাই রাখেন। কোচ-খেলোয়াড়ের মর্যাদার খবরাখবরও মানুষ জানে। তাই কর্তাদের একে অন্যকে মালা পরানো, বিজয়ী নারী দলের সঙ্গে ছাদখোলা বাসে উঠে পড়া দেখতে জনতার ভালো লাগে না। সমালোচনার বিষে কর্মকর্তাদের মানহানিও হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
এ দুটি ঘটনার মধ্যে আবার নারী দলের কয়েকজনের লাগেজ থেকে অর্থকড়ি খোয়া গেছে। তারও আগে, বিমানবন্দরে হুড়াহুড়ি, ঋতুপর্ণা চাকমার চোট পাওয়া কিংবা বাফুফে ভবনে সাবিনাদের সংবর্ধনা—কোথাও পরিকল্পনার ছিটেফোঁটা ছিল না। একটি দ্বিতল বাসকে সাজানো ছাড়া নারী দলকে বরণ করার আর কোনো পরিকল্পনা নজরে পড়েনি। তবে বাফুফে ভবন হলো দেশের ফুটবলের সদর দপ্তর।
তার ওপর এ ভবন সাবিনাদের পেশাদার জীবনের আবাসস্থল। স্বভাবতই নারী দলের শিরোপা জয়কে কেন্দ্র করে এ ভবনটির নতুন সাজে সেজে ওঠার কথা কিন্তু সেসবের কিছু হয়নি পলেস্তারা ওঠা বাফুফে ভবনের গায়ে এক পরত রং লাগেনি, আলোকসজ্জা তো দূরের কথা। অগুনতি মিডিয়ার সামনে কর্মকর্তারা ঠিকই নিজেকে কেতাদুরস্তভাবে উপস্থাপনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ এ বিষয়টি পছন্দ করেনি!
অথচ বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন বলেছিলেন যে, তিনি বিমানবন্দরে যাবেন না। তিনি চান, কর্মকর্তাদের ভিড়ে সাবিনাদের প্রাপ্য মর্যাদা যেন ‘ছিনতাই’ না হয়। সাধুবাদ জানানোর মতোই চিন্তাধারা কিন্তু সেই তিনিই বিজয়ীদের প্রথম আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে কর্মকর্তাদের নিয়ে বসেছেন সামনের সারিতে, পেছনে ঠেলে দিয়েছেন সাবিনা ও গোলাম রব্বানীকে। সালাউদ্দিনের ভাবনার এই পরিবর্তনে যেটুকু বুঝতে পারি, তা হলো মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের পর্যাপ্ত ‘এক্সপোজার’ না দিলে যদি সরকারি অনুদান না মেলে। তবে বুধবার রাতের সমালোচিত সেই সংবাদ সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ও ছিল ফুটবল উন্নয়নে সরকারি তহবিল থেকে বাফুফের সাড়ে ৪০০ কোটি টাকা ছাড় করিয়ে নেওয়া।
এ ছাড় করানোর ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতনদের আশীর্বাদ জরুরি। অযাচিত প্রচারণা দিয়ে সেই আশীর্বাদ সম্ভবত পেয়ে গেছেন সালাউদ্দিন। ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী নিজ মুখে এ রকম আশ্বাসই দিয়েছেন।
তবে একই চর্চা আছে দেশের সবচেয়ে সফল এবং ধনী বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে (বিসিবি)। কোনো কিছু জিতে দল ফিরলে বিমানবন্দরে কর্তারা ভিড় করেন আর হেরে ফেরা দলকে ‘রিসিভ’ করার দিনে তাদের কাউকে দেখা যায় না। অবশ্য নারী ফুটবল দলকে বরণের দিনের মতো ঘটনা ক্রিকেটে এখন আর ঘটে না। একদা সাকিব আল হাসানকে ফ্রেমের পেছনে পড়ে থাকতে হয়েছে; কিন্তু তারকা খ্যাতির ঝাজ দিয়ে পেছনের কাতার থেকে অনেক আগেই সামনে চলে এসেছেন সাকিবরা। এখন উদযাপনের দিনে স্বয়ং বোর্ড সভাপতি মিডিয়ায় উচ্ছ্বাস প্রকাশের সময় পাশে রাখেন অধিনায়ককে। ক্রিকেটে আত্মপ্রচারণার ব্রহ্মাস্ত্র এখন এটাই। তা ছাড়াও বাফুফের মতো বিসিবিও পর্যাপ্ত ‘সম্মান’ দেয় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে।
তবে নিয়মিত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নির্বিঘ্নে আয়োজনের ‘স্বার্থে’ দেশের প্রায় সব মন্ত্রণালয় ও সংস্থাকে সমীহ করে চলে দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাবান ফেডারেশন বিসিবি।
তবে এভাবে সংগঠকদের মনোযোগ অন্যত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ায় সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয় সংশ্লিষ্ট খেলার। কর্তাদের মনোযোগের পুরোটা পান না খেলোয়াড়রা। সফল হলে বুকে জড়িয়ে ধরেন; কিন্তু ব্যর্থতা থেকে সাফল্যের সরণিতে ফেরার পথ যেনো আর কেউ দেখানয় না খেলোয়াড়দের। অথচ সংগঠকদের প্রধান কাজ কিন্তু এটাই খেলাকে, এর প্রতিটি অনুষঙ্গকে ঠিকঠাক পরিচর্যা করা। অনুধাবন করতে হবে, সোনালি সাফল্যের দিনে কোচ ও খেলোয়াড়কে পেছনে ঠেলে সামনে বসার জন্য তারা দায়িত্বপ্রাপ্ত নন। দুঃসময় কাটিয়ে ওঠার পথও দেখাতে হবে। এ সাফল্যের মতো ব্যর্থতারও সমান অংশীদার হবে সংগঠকরা।
এ উপলব্ধি যত দিন না ছড়িয়ে পড়বে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে, তত দিন বুধবারের ছবি দেখতে হবে ভবিষ্যতেও। যথারীতি কালেভদ্রে। তবে এ দেশে চলমান সংস্কৃতি যে, দীর্ঘস্থায়ী সাফল্যের উপযোগী একবারই নয়!