অনলাইন ডেস্ক নিউজ।।
দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে প্রায় ৪৯ জনের মৃত্যু হয় বিএম কন্টেইনার ডিপোতে। মৃত্যুর পর এখন জানা যায় যে, ওই ডিপোসহ সীতাকুণ্ডের শতাধিক কারখানা ও ডিপোর মতো স্থাপনাগুলো ৬মাস আগেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে ইন্সপেকশন বা পরিদর্শন করেছিলো ২টি তদন্ত দল।
ওই দল দুটির একটি নেতৃত্বে দিয়েছেন সীতাকুণ্ডের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন এবং আরেকটির নেতৃত্বে ছিলেন চট্টগ্রামের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক (সেইফটি) মাহমুদুল হাসান।
যে ডিপোতে পরে ভয়াবহ আগুন লেগেছে সেটি তখন পরিদর্শন করেছিলো মাহমুদুল হাসানের নেতৃত্বাধীন দলটি।
তবে উভয় দলেই ফায়ার সার্ভিস, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, বয়লার পরিদর্শকের দফতর ও পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সব বিভাগের প্রতিনিধিরা ছিলেন এবং তারা নিজ নিজ বিভাগের বিষয়গুলো সীতাকুণ্ডের এসব কারখানা ও ডিপোতে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন।
ওই পরিদর্শনের আগেই পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণের সময় সেখানে কোন কোন বিষয়গুলো দেখা হবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও বিনিয়োগ বোর্ডের অনুশাসন অনুযায়ী তার একটি চেকলিস্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে কারখানা ও ডিপোগুলোকে আগে জানিয়ে দেয়া হয়েছিলো।
এমনকি চেকলিস্টের তথ্যগুলো পরিদর্শনের আগেই পূরণ করে রাখা এবং পরিদর্শন টিমকে ডকুমেন্ট/রেকর্ড/রেজিস্টার উপস্থাপন করে সহযোগিতার করার কথাও চিঠিতে বলা হয়েছিলো।
দুর্ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিসসহ সরকারী সব সংস্থা থেকেই বলা হয়েছে যে, বিএম কন্টেইনার ডিপোতে যেসব কেমিক্যাল ছিলো সে সম্পর্কে আগে থেকে কোন তথ্য জানানো হয়নি বলেই ফায়ার সার্ভিসের কর্মীসহ এতো হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
যদিও বাস্তবতা হলো বিএম ডিপোতে সরকারী ওই পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ দল গিয়েছিলো এবং চেকলিস্ট অনুযায়ী বিস্তারিত তথ্য উপাত্তও সংগ্রহ করেছিলো।
অবশ্য মাহমুদুল হাসানের নেতৃত্বাধীন পরিদর্শন দলে থাকা ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা মোল্লা সিকান্দার আলী বলছেন যে, মালিকপক্ষ তখন বিএম কন্টেইনার ডিপোর কন্টেইনারগুলো সম্পর্কে যেসব তথ্য দিয়েছিলেন সেটিই তাদের রিপোর্ট করতে হয়েছে।
এর বাইরে কন্টেইনারে কী ধরণের দ্রব্য আছে সেটি কন্টেইনার খুলে পরীক্ষা নিরীক্ষার অনুমতি ছিলো না।
সে কারণে তারা শুধু চেকলিস্ট অনুযায়ী কাগজপত্র গুলো পর্যবেক্ষণ করেছেন।
তবের”আমরা কাগজপত্র দেখে প্রশ্ন করেছি। তারা বলেছে কন্টেইনারে গার্মেন্ট গুডস। কেমিক্যাল রাখা হয় এমন কোন তথ্যও তারা তখন আমাদেরকে দেয়নি। আর আমাদের চেক করার বা কোন বিষয়ে জোর করার অনুমতি ছিলো না,”
বিএম ডিপু পরিদর্শনের রিপোর্টে কি কি তথ্য দিয়েছিলো পর্যবেক্ষণ দলগুলো
মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন ও মাহমুদুল হাসানের নেতৃত্বাধীন ২টি দল সীতাকুণ্ডের একশর বেশি কারখানা ও ডিপো পরিদর্শন করে বিনিয়োগ বোর্ড চেকলিস্ট দিয়ে সেসব বিষয় দেখতে বলেছিলো সেগুলো সম্পর্কে তথ্য নিয়ে ও যে পরিস্থিতি তারা দেখেছেন নিরাপত্তাসহ আনুষঙ্গিক বিষয়ে সেটি পরে রিপোর্ট আকারে বিনিয়োগ বোর্ডের কাছে দিয়েছেন।
তবে সীতাকুণ্ডের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন
যে, ওই পরিদর্শনগুলো গতানুগতিক ছিল না।
বরং পরিদর্শন করে নিরাপত্তা ইস্যুতে কোথায় কোথায় ঘাটতি আছে সেটা বের করে বিনিয়োগ বোর্ডকে জানাতে বলা হয়েছিলো।
প্রথম কারখানা বা ডিপোগুলো কীভাবে চলছে এবং কোথায় কোথায় ঘাটতি আছে সেগুলো বলতে হয়েছে আমাদের। এছাড়াও টিমে থাকা প্রত্যেকটি দপ্তরের প্রতিনিধিরা তাদের বিভাগের বিষয়-গুলো দেখে সে সম্পর্কে রিপোর্ট দিয়েছেন। ঘাটতি মেটাতে কি কি করতে হবে তা নিয়েও আমাদের সুপারিশ ছিলো,”
(বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি)
তবে এবিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন যে, পুরো কন্টেইনার ডিপো একটি খোলা মাঠের মতো।
খোলা জায়গাতেই কন্টেইনার রাখা থাকে।
তবে পরিদর্শন দলটির কাছে তখনি মনে হয়েছি অগ্নি নিরাপত্তা ইস্যুতে প্রস্তুতি যথাযথ নয় বলে তাদের পানির রিজার্ভার রাখাসহ বেশি কিছু পরামর্শ দেয়া হয়েছিলো।
ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা জনাব, মোল্লা সিকান্দার আলী বলেন যে, “আমরা তখনো জানতাম না যে, কন্টেইনারে আসলে কি কি রাখা হয়। এমনকি দুর্ঘটনার পরেও জানানো হয়নি। আর এমন ঘটনা ঘটতে পারে তা আমরা কোন দিন কল্পনা করতে পারিনি।
এবিষয়ে মাহমুদুল হাসান বলেন যে, বিএম কন্টেইনার ডিপো নিয়ে তারা তাদের মতামতে বলেছেন যে সেখানে খোলা মাঠে মালামাল আপলোড বা আনলোড করা হয় এবং যেভাবে করা হয় সেটি যথাযথ মানসম্মত নয়।
এসব বিষয়ে সেখানকার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে তখন কিছু পরামর্শও দেয়া হয়েছিলো বলে তিনি জানান।
তবে চেক লিস্টে কি কি দেখতে বলা হয়েছিলো
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তথ্য চেয়ে যে, চেকলিস্ট আগেই কারখানা ও ডিপোগুলোতে পাঠিয়েছিলেন তাতে প্রতিষ্ঠানের পরিচিতি, মালিক ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের তথ্য ছাড়াও ট্রেড লাইসেন্স, ফায়ার সার্ভিস ছাড়পত্র, বৈদ্যুতিক অনুমোদনপত্র, পরিবেশ ছাড়পত্র, বিস্ফোরক অধিদপ্তরের লাইসেন্স বা অনুমতিপত্র আছে কিনা দেখতে বলা হয়েছিলো।
এর বাইরে জেলা প্রশাসন, গ্যাস বিতরণ কোম্পানি, জ্বালানি বিভাগ, মাদক অধিদপ্তর, পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনসহ মোট চৌদ্দটি প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্র বা অনুমোদন ছিলো কি-না তা যাচাই করার জন্য বলা হয়।
তবে এই চেক লিস্টে অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ফায়ার হাইড্রেন্ট সিস্টেম কার্যকর আছে কি-না, প্রতি ফ্লোরে হোজপাইপ/হোজ রিল আছে কি-না, হাইড্রেন্ট ও পাম্প আছে কি-না, অটো ট্রান্সফার সিস্টেম আছে কি-না, ফায়ার সেফটি প্ল্যান আছে কি-না, পিলার হাইড্রেন্ট ও স্প্রিঙ্কলার আছে কি-না, ভূগর্ভস্থ জলাধার কেমন -এমন বেশ কিছু তথ্য চাওয়া হয়ে ছিলো।
কিন্তু এসব কিছু তারা খতিয়ে দেখেননি এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি পর্যবেক্ষণ দলটির নেতা জনাব, মাহমুদুল হাসান ও দলের ফায়ার সার্ভিসের প্রতিনিধি মোল্লা সিকান্দার আলী।
অবশ্য তারা বলেছেন খালি চোখে যেটুকু ঘাটতি দেখেছেন তা নিয়ে তারা সেখানকার কর্মকর্তাদের সতর্ক করার পাশাপাশি বিনিয়োগ বোর্ডকেও জানান।
যদিও ওই চেকলিস্ট অনুযায়ী কারখানা বা ডিপোর কাঠামোগত নিরাপত্তা, অগ্নি নিরাপত্তা, বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা, মেশিন নিরাপত্তা, বয়লার নিরাপত্তা, বিস্ফোরণজনিত নিরাপত্তা ও পরিবেশগত নিরাপত্তা সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য পরিদর্শন-গুলোর হাতে থাকার কথা ছিলো।
কিন্তু বাস্তবতা এই হলো যে, পরিদর্শনের প্রায় ছয় মাসের মাথায় এসে ভয়াবহ বিস্ফোরণ।
তবে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে যাতে ফায়ার সার্ভিসের প্রায় দশ জন কর্মীও মারা গেলেন দফায় দফায় বিস্ফোরণ ঘটার কারণে।
(তথ্য সংগ্রহ বিবিসি বাংলা)